সম্প্রতি ইউটিউবের কল্যাণে আশফাক নিপুণ পরিচালিত একটি নাটক দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। নাটকের নাম ‘ফেরার পথ নেই’। নাটকটি ঈদের ৩য় দিন প্রচার হয়েছে বেসরকারী চ্যানেল এসএ টিভিতে। তবে আমার দেখার সৌভাগ্য হয়েছে ইউটিউবে। সৌভাগ্য বলছি একারণে যে নির্মাতা এই নাটকে যেই বিষয়কে তুলে আনার সাহস এবং ইচ্ছা দেখিয়েছেন তেমনটি এই চুপ মারা সময়ে বড় বড় ডাকসাইটে নির্মাতারাও করতে ভয় পান। এখন চুপ মারা সময়। ‘উন্নয়নের জোয়ারে’ ভাসা দেশে সবাই তাই চুপ। সাংবাদিকেরা চুপ। বুদ্ধিজীবীরা চুপ। শিক্ষকেরা চুপ। শিল্পীরা চুপ। ছাত্ররা চুপ। তাই জনগণও চুপ। এখন কোন কিছু বলার আগে যাচাই করে দেখতে হয় সে বিষয়টি নিয়ে বলাটা নিরাপদ কিনা।
সাংবাদিকেরা ‘মাননীয়দের’ সামনে ভেজা বেড়াল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর বুদ্ধিজীবীদের হাত তেলে চপচপ করছে। ছাত্ররা আর জনগণ সব কিছুর উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে চুপ। শিল্পী সাহিত্যিকেরা ‘নিরাপদ’ ইস্যুতে নাটক বানান, গান করেন, গল্প-কবিতা-উপন্যাস লেখেন। তাই ঢাকা অ্যাটাকের মতো সিনেমা হয়। ঈদের নাটক ভর্তি থাকে ন্যাকা ন্যাকা মধ্যবিত্তীয় প্রেম আর ছ্যাবলামিতে। হীরক রাজার দেশে সিনেমাতে আমরা যে শিল্পীকে দেখি প্রবল নিপীড়ন ও নির্যাতনের মধ্যেও সমাজের আসল চেহারা নিয়ে গান গাইতে সেই ‘কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়’ গানের মতো কোন গান বা সৃষ্টি তৈরি করার কাজ থেকে এদেশের শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীকুলের বেশিরভাগ এখন হাত গুটিয়ে রেখেছেন। কিন্তু এই বর্তমানের শিল্পী-কবি-সাহিত্যিকদেরই তো কত অমর সৃষ্টি আছে!
বেশি দূরে যেতে হবে না, স্বৈরাচারী এরশাদের আমলে তাকালেই হবে। সুতরাং তাদের তেমন নাড়া দেয়ার মতো সৃষ্টি তৈরি করার সক্ষমতা নাই তেমনটা কিন্তু বলা যাবে না। সক্ষমতা আছে। সমস্যাটা হলো তারা এখন ক্ষমতা কাঠামোর সাথে গাঁটছড়া বেধেছেন। মানসিক শ্রম বেচতে গিয়ে তারা মাথাটাকেই বেচে দিয়েছেন। তাতে দু’পয়সা কামাইও হচ্ছে। আর এতে করে তারা তাদেও বুদ্ধিজীবী চরিত্রটাই হারিয়ে ফেলেছেন। তৈরী হয়েছেন দলদাসে। সুতরাং চুপ থাকো। রাষ্ট্রের নিপীড়ক চরিত্রটাকে দেখেও না দেখার ভান করে থাকো। আর টেলিভিশনে বিদেশী ভাষার সিরিয়াল বাংলায় ডাবিং করে দেখানোর বিরুদ্ধে আন্দোলন কর! সঞ্জীব চৌধুরী গেয়েছিলেন ‘সব নিষিদ্ধ’। সেই নিষিদ্ধ হওয়া এখন এই পোড়ার দেশে আরো বেশি জাঁকিয়ে বসেছে শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের কাছা খুলে রাষ্ট্রের ক্ষমতা কাঠামোর কাছে আত্মসমর্পন করার কারণে।
তো কি তুলে ধরেছেন আশফাক নিপুণ তার নাটকে যে এত কথা বলছি? আশফাক নিপুণ তার ফেরার পথ নেই নাটকে দুটি দম্পতির প্রেমের গল্প শুনিয়েছেন (ঈদের নাটক হিসেবে খুবই উপযোগী বিষয়)। কিন্তু তিনি কেবল সেই প্রেমেই আটকে থাকেন নি। নাটকের প্রথম ভাগে এক নিচুতলার দপ্ততির কাহিনী দেখিয়েছেন যেখানে স্বামীটি চোর। তেল চুরি করার কারণে তার বউ তাকে সারাক্ষণ বকে, ঝগড়া করে। আবার দুজনার মিষ্টি একটা মিটমাটও হয়। বউকে সে খুব ভালবাসে। কিন্তু সে চুরি ছাড়তে চেয়েও ছাড়তে পারে না দীর্ঘদিনের অভ্যাসবশত। শেষমেষ একদিন যখন তার বউ তাকে তার অনাগত সন্তানের কথা জানায় তখন সে বউয়ের কাছে প্রতিজ্ঞা করে যে চুরি ছেড়ে দিয়ে সে ভাল হয়ে যাবে। তার এতদিনের পরিচিত এলাকা ছেড়ে তারা দুজন দূরে অন্য কোথায় গিয়ে উঠবে যেখানে সে ভাল হতে পারবে। যেখানে কেউ তাকে চুরি করার জন্য বাধ্য করবে না। এতক্ষণ পর্যন্ত দেখার পর এটাকে গতানুগতিক প্রেমের নাটকই মনে হবে। কিন্তু আসল টুইস্ট আসে এরপর। স্বামীটি যখন বউয়ের কাছ থেকে অনাগত সন্তানের সংবাদ পেয়ে খুশিতে আত্মহারা তখন সে বাইরে যায় কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসছে এই কথা বলে। কিন্তু তার আর ফিরে আসা হয় না। এরপর বউ অনেকক্ষণ পর যখন তাকে ফোন দেয় তখন ওই প্রান্ত থেকে শোনা যায় স্বামীটির বিষাদগ্রস্ত ভেঙ্গে পরা, কান্নাবিজড়িত কন্ঠস্বর। সে আবারো ফিরে আসার কথা জানায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফিরে আসে না। অবশেষে বউ পরিচিত একজনের কাছে গিয়ে জানতে পারে তার স্বামীকে মাদক ব্যবসায়ী বলে বন্দুকযুদ্ধের নামে মেরে ফেলা হয়েছে।
পুরো ঘটনাটি আপনাকে কিছুদিন আগে ‘বন্ধুকযুদ্ধে’ টেকনাফের একরামুল হক নিহত হওয়ার পর যে অডিও বের হয়েছিল সেই অডিওর ঘটনাটিকে মনে করতে বাধ্য করবেই। তেলচোর স্বামীর বউ যখন বুকফাটা হাহাকার করে বলেন যে তার স্বামী ছিচকে চুরি করত কিন্তু মাদক ব্যবসায়ী ছিল না কোন কালেই তখন আপনি তার মধ্যে একরামুল হকের স্ত্রী ‘উনি কিছু করে নাই যে’ বলে ফোনে যে বুকফাটা আর্তচিৎকার করেছিলেন সেটিকেই শুনতে পাবেন ভীষণ পরিস্কারভাবে এবং ভীষণ অস্বস্তি নিয়ে।
আশফাক নিপুণ নাটকের দ্বিতীয় ভাগে আরো দেখিয়েছেন যে এহেন রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন শুরু হলে কেবল সমাজের নিচুতলার মানুষই যে আক্রান্ত হন তা নয় কিন্তু। তিনি দ্বিতীয় ভাগে মধ্যবিত্ত-উচ্চ মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তদের এটাই দেখাতে চেয়েছেন যে নগর পুড়লে দেবালয়ও রক্ষা পাবে না। আক্রান্ত হবে সবাই। দ্বিতীয় ভাগে আরেক উচ্চ মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ী স্বামীর সাথে তার স্ত্রীর মধুর প্রেমকাহিনী তাই পরিণতি পায় স্বামীটির গুম হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। কারা যেন তাকে ‘সাদা মাইক্রোবাসে’ করে তুলে নিয়ে যায়। এর পর আর তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না।
নির্মাতা নাটকে কোন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নাম না নিলেও তিনি যে প্রেক্ষাপটে ইস্যুগুলোকে তুলতে চাইছেন সেটিকে যে মোটেও আড়াল করতে চাননা সেটি বোঝা যায় কয়েকটি জায়গায়। খুব ছোট ইনসার্ট শটে দেখিয়েছিন বড় কয়েকটি ইঙ্গিত। টেকনাফের সাংসদ আবদুর রহমান বদি ইয়াবা ব্যবসায়ে জড়িত নন বলে দাবী করেছেন এই মর্মে টিভিতে সংবাদ চলছে, পরবর্তী দৃশ্যে মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের কথা বলছেন। পাশাপাশি নাটকের চরিত্র যখন সংবাদপত্র পড়ছেন তখন এটাও দেখান যে পত্রিকায় রিপোর্ট হয়েছে বন্দুকযুদ্ধে মাদক ব্যবসায়ী নিহত। সুতরাং খুব খোলাখুলিই তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন যে তিনি আসলে কোন প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন।
এই চুপ মারা সময়ে যেখানে শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীরা সবাই গুম আর বন্দুকযুদ্ধ শব্দদুটো উচ্চারণ করতেই সাহস পান না সেখানে ঈদের নাটকে এই দুই বিষয়কে তুলে আনা নিঃসন্দেহে ভীষণ সাহসের একটা কাজ। এমনটা করতে বুকের পাটা লাগে। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা অনুভব করা লাগে।
তবে দর্শক হিসেবে একটি কথা না বলে পারা যাচ্ছে না যে নাটকের অভিনয় নিয়ে খুব একটা অভিযোগ করার জায়গা না থাকলেও নাটকের নির্মাণশৈলীতে পরিপক্কতার ছাপ যথেষ্ট ছিল না। এ জায়গাটাতে নির্মাতা আরো একটু সময় নিয়ে গভীরে যেতে পারতেন। কিন্তু একটা জায়গায় নির্মাতা খুব সফল। আর তা হল আমাদের ‘এভরিথিং ইজ কুল’ মার্কা চিন্তাধারাতে ব্যাঘাত ঘটানো। চীন বিপ্লবে অংশ নেয়া কানাডার ডাক্তার নর্মান বেথুন একবার বলেছিলেন, ‘শিল্পীর প্রধান কাজ হচ্ছে ডিস্টার্ব করা’। সেই ‘ডিস্টার্ব’ করার কাজে নির্মাতা আশফাক নিপুণ সফল। নির্মাতা আশফাক নিপুণকে তাই অভিনন্দন ও স্যালুট। সেই সঙ্গেে এসএ টিভিকেও এই নাটকটি প্রচার করার জন্য অভিনন্দন জানাই! আশফাক নিপুণের কাছ থেকে এ ধরনের বিষয়ে আরো পরিপক্ক কাজ ভবিষ্যতে পাব সেই আশাই করি।
পাশাপাশি আরেকটি কথাও আমাদের ভাবা দরকার। এই যে আমরা রাষ্ট্রীয় সকল নিপীড়নে ‘চুপ মেরে’ আছি তাতে করে একদিন এমন সময় আসবে যখন ‘আমাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আর কাউকে পাওয়া যাবে না’। এই অনিরাপদ সময়ে তাই নিরাপদ থাকার, হীরক রাজ্যের দেশে পরিণত না হওয়ার জন্য একটাই উপায় আছে আর তা হল আরো সরব হওয়া এবং আরো সক্রিয় ও সংগঠিত হওয়া। যত তাড়াতাড়ি এই কথা আমরা উপলব্ধি করতে পারবো ততই আমাদের মঙ্গল।